Blogs

আমার স্কুল, আমার পরিবার

তখন ছিল অরবিন্দ আশ্রম। The Future Foundation School নামটা পরে হয়েছে। আমাকে বাবা হাত ধরে এনে ভর্তি করে দিলেন।

“ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় “… সেই থেকেই বড়ো প্ৰিয় জায়গা আমার। প্রথম দু’দিন  কেঁদেছিলাম। তারপর শুধুই আনন্দ।

বাবা বলতেন ” এই স্কুলটা একটুকরো দেবভূমি, এক খন্ড  স্বর্গ “.. ওটাই মাথায় পাক খেত। কী সুন্দর লাগতো স্কুলটা। গাছপালায় মাখামাখি করা জায়গা। শুধু সবুজ। মাটির গন্ধ। আমাদের তখনকার অধ্যক্ষা জয়া মিসকে দেখলে মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জাগতো। মনে পড়ে, সাধারণত সাদা রঙের শাড়ি পরতেন বেশি। দূরের মানুষ ছিলেন না, কাছের জন ছিলেন। সবার কাছে আসতেন,সবার খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। অবাক চোখে দেখতাম তাঁকে, কী সুন্দর ব্যক্তিত্ব!

তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। কারণ নিশ্চই একটা ছিল, এখন সেটা স্মৃতিতে ফিকে।

পড়াশোনা চলতে লাগলো আপন গতিতে। বাংলা বিষয়টিকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেললাম।

তখন সপ্তম শ্রেণী। বাবা বললেন একটা কবিতা লেখো। বাংলায় একটা কবিতা লিখেছিলাম, কবিতাটা মনে নেই, কিন্তু কবিতাটা ছিল এই অরবিন্দ আশ্রম স্কুলকেই কেন্দ্র করে। মনে পড়ে, একটা ছবি এঁকেছিলাম এই স্কুলের পরিবেশ, আমাদের ক্লাস টিচার ছোট্টখাটো ভারতী মিসের। তারপর কেঁদেছিলাম, আমায় কেন ওই স্কুল থেকে নিয়ে এলে বাবা!

স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়, মিনিট সাতেক। বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে স্কুলের চারপাশে পাক কাটতাম, চোখ ভরে দেখতাম, স্কুলের গন্ধ নিতাম।

উচ্চশিক্ষা শেষে ভেবেছিলাম শিক্ষকতা করবো। শিক্ষক বাবা আমার অনুপ্রেরণা। বাংলা নিয়েই আমার পড়াশোনা। তারপর কলকাতা শহরের দুটি স্কুলে পড়ালাম। এরপর ব্যক্তিগত কারণে বিরতি।

তারপর আবার এই দেবভূমিতে ফেরা। তখন এই স্কুল “The Future Foundation ” নিজ কর্মে, নিজ গুণে অনেক অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। চারিদিকে তার খ্যাতি, নাম। ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি পা বাড়ালাম আমার প্ৰিয় জায়গাটিতে। ডাক পেলাম। প্রক্রিয়া চলল নিজের মত করে। তারপর দেখা হলো অধ্যক্ষ মহাশয় শ্রী রঞ্জন মিত্রের সঙ্গে। অনেকদিন আগে জয়া মিসের সঙ্গে দেখেছিলাম স্যারকে। আবার কতদিন পরে দেখা।

ছাত্রী হিসেবে ঢুকেছিলাম সেই ছোট্টবেলায়, এবার শিক্ষিকারূপে এলাম। ততদিনে বাবা গত হয়েছেন। হয়তো তাঁর আত্মা শান্তি পেলো এখানে শিক্ষিকারূপে মেয়েকে দেখে।

সেই পরিবেশ একইরকম সুন্দর। সেই একতা অটুট, সেই ভালোবাসা, সকলের প্রতি অপার স্নেহ…. সবই বর্তমান। আহা, প্রাণ যেন প্রাণ পেল। সে এক অনির্বচ্চনীয় অনুভূতি! আত্মার আরাম!

পড়াতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আমার পরিচিত ভালোবাসার জায়গায় পড়াতে পেরে আরও ভালো লাগলো।

আমাদের স্কুলের বিশেষত্ব হলো, আর পাঁচটা অন্য স্কুলের মত বাঁধাধরা গতে পুঁথিগত বিদ্যার উপর অন্ধের মত জোর না দেওয়া। শিশুটি তার ভেতরের অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া পেয়ে যা করতে ইচ্ছুক, সেই নির্যাসটুকুকে লালন করা। একটি ছোট চারাগাছকে যেভাবে আমরা বেড়া দিয়ে আগলে রক্ষা করি, সেভাবে তাকে গড়ে তোলা। তাদের মত করে,তাদের ভালোলাগাকে পরিপূর্ণতা দেওয়া। আর আছে শিক্ষিকাদের পড়ানোর স্বাধীনতা। চারদিকের ছোট ছোট বিষয়ও যে কতটা শিক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে সেটা এখানে না এলে বোঝা যাবে না। শিক্ষার সঙ্গে শিশুদের সার্বিক সকলরকম উন্নতির পন্থা ঠিক করে রাখা আছে আমাদের স্কুলে। এখানে সবাই একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি আমরা। এখানে কেউ বেশি নয়, কেউ কম নয়। উড়োজাহাজের উপর থেকে যেমন সব সমান দেখতে লাগে, সব রঙিন লাগে, এখানেও তাই।

প্রতি বছর ডিসেম্বরে আমাদের স্কুলে “আস্পৃহা”(Aspiration) হয়। অনেক মানুষের সমাগম হয়। বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ আসেন। গান, নাচ, নাটক,বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে থাকে দিনগুলো। সকলের সঙ্গে দেখা হওয়া, সংস্কৃতির মেলবন্ধন, কৃষ্টির আলাপন সবই আমাদের এই স্কুলকে ঘিরেই সম্পন্ন হয়। প্রতি বছর খুব ভালো ফল করে ছাত্র ছাত্রীরা, গর্বে ভরে ওঠে বুক।

মাঝে বছর তিনেকের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম। অধ্যক্ষ মহাশয়কে যাওয়ার আগে বলেছিলাম, ‘ফিরে এসে শ্রীমা – শ্রী অরবিন্দর পায়ে আবার ঠাঁই পাবো তো?’ স্যার আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন -“অবশ্যই”…

ঠাঁই পেয়েছি আবার। ছেলেকেও ভর্তি করেছি এই দেবভূমিতে। প্রথাগত, একঘেয়ে পরিবেশ এখানে নেই। এখানে আমরা রোজ নতুন করে বাঁচি। কিন্তু আছে এক অদৃশ্য নিয়ম। সবাই সেই নিয়মে আছি আমরা। নিয়ম মেনেই তো চন্দ্র সূর্য ওঠে, দিনরাত হয়, ঋতু পরিবর্তন হয়। আমরাও সেই কঠোর নিয়মেই চলি। তবে সেই কঠোরতার কখনো গলার ফাঁস হয়ে দেখা দেয় নি, এই নিয়ম ভালোলাগার নিয়ম, ভালোবাসার নিয়ম, ঐক্যবদ্ধ, একনিষ্ঠ হওয়ার নিয়ম। যাকে আমরা বলি ‘discipline.’

আমার স্কুল আমার কাছে “my second home “.. এখানে ঢুকলেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়, আমি অসম্ভব মানসিক শান্তি পাই। আমার স্কুলকে আমি বড্ড ভালোবাসি।

আমি অরুন্ধতী চক্রবর্তী। The Future Foundation স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। শিক্ষক পিতার আদর্শে বড়ো হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রেরণা। পড়ানো শুধু পেশা নয়, নেশাও। আর গান গাওয়া, লেখালেখি আর বাগান করা আমার ভালোবাসা।